আমন ধান চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত জানুন

বাংলাদেশে ধানের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। ধানের প্রজাতির মধ্যে আমন ধান উৎপাদনের দিক দিয়ে বাংলাদেশে শীর্ষ অবস্থান করছে। অনেকেই হইত আমন ধান চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক নিয়ম জানেন না। আজকের আর্টিকেল এ আমন ধান চাষ পদ্ধতি এবং আমন ধানে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক নিয়ম বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 
আমন ধান চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত জানুন
আপনি যদি আমন ধান চাষ পদ্ধতির সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জেনে ধানের ফলন বৃদ্ধি করতে চান ও ভালো ফলন পেতে চান তাহলে এই আর্টিকেল টি সম্পুরন মনোযোগ সহকারে পড়ুন।

আমন ধানের জাত সমূহ 

  • বিআর ৪,        বিআর ৫, 
  • বিআর ১০,      বিআর ১১,
  • বিআর ২২,     বিআর ২৩
  • বিআর ২৫,     ব্রি ধান ৩০,
  • ব্রি ধান ৩১,     ব্রি ধান ৩২,
  • ব্রি ধান ৩৩,     ব্রি ধান ৩৪
  • ব্রি ধান ৩৭,     ব্রি ধান ৩৮
  • ব্রি ধান ৩৯,     ব্রি ধান ৪০
  • ব্রি ধান ৪১,      ব্রি ধান ৪৪
  • ব্রি ধান ৪৬,     ব্রি ধান ৪৭
  • ব্রি ধান ৪৯,     ব্রি ধান ৫১
  • ব্রি ধান ৫২,     ব্রি ধান ৫৩
  • ব্রি ধান ৫৪,     ব্রি ধান ৫৬
  • ব্রি ধান ৫৭,     ব্রি ধান ৬২
  • ব্রি ধান ৬৬,    ব্রি ধান ৭০
  • ব্রি ধান ৭১,      ব্রি ধান ৭২
  • ব্রি ধান ৭৩,     ব্রি ধান ৭৫
  • ব্রি ধান ৭৬,     ব্রি ধান ৭৭
  • ব্রি ধান ৭৮,     ব্রি ধান ৭৯
  • ব্রি ধান ৮০,     ব্রি ধান ৮৭
  • ব্রি ধান ৯০,     ব্রি ধান ৯১
  • ব্রি ধান ৯৩,     ব্রি ধান ৯৪
  • ব্রি ধান ৯৫,    ব্রি ধান ১০৩

আমন ধানের জন্য উপযুক্ত মাটি 

আমন ধান প্রায় সব মাটিতেই চাষ ভালো হয়। কিন্তু 10 পার্টির মত বেশি জল ধারণ ক্ষমতার মাটি ধান চাষের জন্য বেশি উপযোগী। মাটির পিএইচ মান সাধারণত ৫.৫ থেকে ৬.৫ হয়।

আমন ধান লাগানোর সময় 

জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে রোপা আমন বীজ বোনা হয় এবং শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে প্রধান জমিতে রোপন করা হয় । চৈত্র ও বৈশাখ মাসে বোনা আমন বীজ রোপন করা হয়।

আমন ধান চাষ পদ্ধতি 

বীজ বাছাইঃ আমন ধান চাষ পদ্ধতির প্রথম কাজ হল বপনের জন্য সুস্থ বীজ নির্বাচন করা। কারণ সুস্থ বীজ মানে সবল চারা। যদিও বর্তমানের সব কৃষকরা কিনা বীজ ব্যবহার করেন তাই বীজ বাছাইয়ের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যে সকল কৃষক ভাইয়েরা দেশি বীজ রোপন করতে চান তারা ১০ লিটার পানিতে ও ১৬৫০ গ্রাম নুন ওই পানির মধ্যে ভালোভাবে মিশিয়ে বীজগুলো ভেজান। তারপর বীজগুলোকে ৩-৪ বার ভালোমতো ধুয়ে রোপন পারেন।

বীজ জাগ দেয়াঃ শোধনকৃত বীজ ২ থেকে ৩ স্তর শুকনো খড় বিছিয়ে তার ওপর শোধনকৃত বীজগুলো রেখে তার ওপর আরো দুই থেকে তিন স্তর শুকনো খড় দিয়ে ভালোভাবে চেপে কোন ভারী জিনিস দিয়ে চেপে রাখুন। আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ভালো বীজের অংকুর বের হবে এবং তা বপনের উপযুক্ত হবে।

ধানের বীজতলা তৈরীর নিয়মঃ আমন ধান চাষ পদ্ধতির অন্যতম শর্ত হল ধানের জন্য ভালো বীজতলা তৈরী করা। জমির কাছাকাছি পানির ব্যবস্থা আছে এরকম জায়গায় দোআঁশ বা এটেল মাটির জমি হলে ভালো হয়। পাশের জমির থেকে একটু উঁচু জমি আমন ধানের বীজ তোলার জন্য ভালো। বীজতলার মাপ সাধারণত এক বিঘা জমির জন্য দুই কাঠা। ব্রিজগুলো পাতলা করে ছিটিয়ে ফেললে ভালো তাহলে চারা গুলো সুস্থ সবল এবং মোটা হবে।
আমন ধান চাষ পদ্ধতি
বীজ বপন পদ্ধতিঃ ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম বীজ বুনতে হবে প্রতি বর্গমিটারে। বীজ বপনের সময় থেকে চার থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত পাখিরা যাতে বীজ নষ্ট না করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

বীজের সাধারণ পরিচর্যাঃ বীজ গজানোর ৫ থেকে ৬ দিন পর বেডের উপর তিন থেকে চার সেন্টিমিটার পানি রাখা ভালো তাহলে পাখির আক্রমণ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শীতের মৌসুমে চারা রক্ষার জন্য পরথীন দিয়ে ঢেকে রাখা হয় যার কারণে ঠান্ডা জনিত ক্ষতি থেকে চারা রক্ষা পায় এবং চারা ভালোভাবে বাড়তে পারে। চারাই হালকা ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে চারা ভালোভাবে বাড়ে এবং চারাগুলো সবুজ হয়। জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগের পর পানি ধরে রাখা উচিত।

চারা উঠানো ও বহন পদ্ধতিঃ চারা উঠানোর পূর্বে বীজতলায় বেশি করে পানি দিয়ে মাটি নরম করে নিতে হবে। চারা অনেক সাবধানে সঙ্গে উঠাতে হবে যেন চারার কান্ড ভেঙে না যায়। চারা উঠিয়ে শুকনো খড় দিয়ে বান্ডিল করে রাখতে হবে। অনেক সময় বীজতলা থেকে চারা বস্তাতে করে বহন করার সময় পাতা ও কান্ড ভেঙে যেতে পারে তাই ঝুরিতে করে শারি করে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।

রোপণের জন্য জমি তৈরি পদ্ধতিঃ রোপনের জন্য জমি অবশ্যই নরম ও সমান হতে হবে। ভালোভাবে জমি চাষ করলে সাধারণভাবে আগাছা নিয়ন্ত্রণে থাকে। জমিকে ভালোমতো কাদা করতে হবে কারণ ভালো মতো কাদা করতে পারলে জমিতে পানি অনেক সময় ধরে আটকে থাকবে।

চারা রোপন পদ্ধতিঃ আমন ধান চাষ পদ্ধতির একটি গুরুপ্ত পূর্ণ পার্ট হচ্ছে চারা রোপণ পদ্ধতি। চারা রোপনের সময় জমিতে হালকা পানি থাকলেই চলবে। মাটির ২ থেকে ২.৫ অথবা ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চি গভীরে চার রকম করা উত্তম। বেশি গভীরে চারা পুতলে চারা বাড়তে দেরি হয়। সঠিক গভীরতায় যারা রোপন করলে যারা দ্রুত বাড়তে শুরু করে এবং খুশির সংখ্যা বাড়ে। চারা অবশ্যই সারি ভাবে লাগাতে হবে।সারি থেকে সারির দূরত্ব মোটামুটি ২৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। কারণ শাড়ি ভাবে চারা রোপন করলে বেশি ফলন পাওয়া যায়।

আমন ধানে সার প্রয়োগ পদ্ধতি

শেষ চাষের সময় জমিতে ইউরিয়া সার ছাড়া অন্যান্য সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করতে হবে । চারা লাগানোর ১২ থেকে ১৫ দিন পর প্রথমবার ইউরিয়া সার জমিতে অতিরিক্ত প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার প্রথম প্রয়োগের 15 থেকে 20 দিন পর দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করতে হবে এবং তার ১৫ থেকে ২০ দিন পর তৃতীয়বার প্রয়োগ করতে হবে ।

স্বল্প মেয়াদী জাতের ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োগ চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পর দ্বিতীয় প্রয়োগ ৪ রকমের ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর এবং শেষ প্রয়োগ কাইচথড় আসার৫ থেকে ৭ দিন আগে। দীর্ঘমেয়াদী জাতের ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োগ শেষ চাষের সময় দ্বিতীয় প্রয়োগ চারা রোপনের ২০ থেকে ২৫ দিন পর শেষ প্রয়োগ কাইচথড় আসার পাঁচ থেকে সাত দিন আগে।
আমন ধানে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে জৈব সারের সাথে রাসায়নিক সার মিক্স করে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও ফলন আরো ভালো হয়। জমিতে বছরে একবার হলেও ৬৫০ থেকে ৭৫০ কেজি জৈব সার ব্যবহার করা উচিত। জৈব সার ব্যবহার করা হবে সে জমিতে ভালো ফলন হবে এবং বড় মৌসুমে ইউরিয়া সার তিনভাগের এক ভাগ কম প্রয়োগ করতে হবে।

টিএসপি ও এনপিও স্যার অর্ধেক মাত্রায় ব্যবহার করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে তাছাড়া ধান কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ১২ থেকে ১৪ ইঞ্চি ওপরে কেটে অবশিষ্ট অংশ মাটিতে মিশিয়ে দিলে পটাশ সারের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ কম লাগে। দস্তা বা জিংক সালফেট সার মৌসুমের যেকোনো একটি ফলনে ব্যবহার করলে তা পরবর্তী ২ ফসলের জন্য ব্যবহার না করলেও চলবে।

আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করণীয় 

আমন ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্য প্রথমে ভালো ধানের জাত নির্বাচন করতে হবে। এরপর আমন ধানে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিকূল এবং অনুকূল পরিবেশ উপযোগী বিভিন্ন জাত রয়েছে। অনুকূল পরিবেশের উপযোগী জাতগুলো হল বি আর ৪, বি আর ৫, বি আর ১০, বি আর ১১, ব্রি ধান ৩০, ব্রি ধান ৩২, ব্রি ধান ৩৩, ব্রি ধান ৩৪, ব্রি ধান ৪৯, ব্রি ধান ৬২, ব্রি ধান ৭৯, ব্রি ধান ৮০, ব্রি ধান ৮৭।

প্রতিকূল পরিবেশ যেমন খরা প্রবন এলাকায় ব্রি ধান ৫৬, ব্রি ধান ৫৭ ও ব্রি ধান ৬৬ এবং যে সকল এলাকা বন্যা প্রবণ সেসব এলাকার জন্য উপযোগী জাতগুলো হল ব্রি ধান ৫১, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান ৭৯। এছাড়াও প্রিমিয়াম কোয়ালিটি জাত দিনাজপুর নওগাঁ সহ যেসব অঞ্চলে সুগন্ধি ধানের চাষ করা হয়। সেখানে বি আর ৫, ব্রি ধান ৩৪, ব্রি ধান ৩৭, ব্রি ধান ৭০, ব্রি ধান ৭৫ ও ব্রি ধান ৮০ চাষ করা হয়।

আমন ধান চাষ পদ্ধতিতে ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্য ভালোমতো ২০ তলা তৈরি করতে হবে। বীজতলা সব সময় উঁচু এবং উর্বর জমিতে তৈরি করতে হবে যেন বন্যার পানি ওঠার কোন সম্ভাবনা না থাকে। যেসব অঞ্চলে উঁচু জমি নেই ওইসব অঞ্চলে ভাসমান বীজতলা তৈরি করার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। উর্বর মাটিতে বীজ তলার জন্য জন্য কোন প্রকার সার প্রয়োগ না করলেও চলবে। বীজ তোলার জন্য জন্য ভালো বীজের কোন বিকল্প নেই।

আমন বীজতলায় অনেক সময় বাঁকানো রোগ দেখা যায়। বাঁকা নিয়ে রোগাক্রান্ত ধানের চারা স্বাভাবিক চারা হালকা সবুজ স্বাভাবিক চারা চেয়ে লম্বা হয়ে অন্য চারার উপরে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত চারাগুলো পরস্পর মারা যায় । তাই বাঁকানি রোগ নিরাময়ে ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটোস্ট্রিন ৫০ নোইন মিশিয়ে চারা ১০ থেকে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা।

চারা রোপনের সময় লাইন বা সারিবদ্ধ ভাবে চারাগুলো লাগাতে হবে। উত্তর দক্ষিণ শাড়ি করে লাগানো ভালো কারণ এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। সারি থেকে সারির দূরত্ব মোটামুটি ৮ ইঞ্চি ও গুচি থেকে গুছিয়ে দূরত্ব ছয় ইঞ্চি রাখলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। মাটির উর্বরতা ও আবহাওয়া, ধানের জাত এর ওপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদী জাতের ক্ষেত্রে বিঘাতে প্রায় ইউরিয়া ,টিএসপ, জিপসাম যথাক্রমে ২৬, ১৪, ৯ কেজি মতো প্রয়োগ করতে হবে।

অঞ্চল ভেদে আমনের মুখ্য পোকা গুলো হল মাঝরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুঙ্গি পোকা, সবুজ গাছ ফড়িং, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধী পোকা ইত্যাদি। এ সকল প্রধান প্রধান পোকাগুলো নিরাময় করতে পারলে এমন মৌসুমে শতকরা ১৭ ভাগ বেশি ফলন হতে পারে। এইসব পোকা গুলো দমনের জন্য সানটাপ ৫০ পাউডার প্রতি বিঘাতে ১৭৫ থেকে ১৮৫ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। এবং ধান যথাযথভাবে সঠিক সময়ে পরিচর্যা করতে হবে তাহলে আমন ধানের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

আমন ধান কাটার সময়

আমন ধান প্রধানত দুই প্রকার রোপা আমন ও বোনা আমন । রোপা আমন মূল জমিতে শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের রোপণ করা হয় এবং অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে সেই পাকা ধান কাটা হয়। বোনা আমন চৈত্র ও বৈশাখ মাসে লাগানো হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়।

লেখকের মন্তব্য

বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে আমন ধান অনেক গুরুপ্তপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। অনেক কৃষক ভাই আমন ধান চাষ পদ্ধতি ও আমন ধানে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক নিয়ম না জানার কারনে ধান চাষ করে ভালো ফলন হচ্ছিলো না। আজকের আর্টিকেল টি যদি আপনি সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকেন তাহলে আপনি আমন ধান চাষ করে ভাল ফসল ফলাতে পারবেন এবং ধান চাষ করে লাভবান হতে পারবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url